তিন দিনের মাথায় শ্রীনগর থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম এক এক করে সোনমার্গ (যদিও এখানে সর্বত্র সোনামার্গ-ই লেখা) আর গুলমার্গ দেখতে। বরফে রাস্তা বন্ধ থাকায় গতবার সোনমার্গ যাওয়া যায়নি। তাই আগে ওদিকটাই ঘুরে নিলাম। এখানে মার্গ মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পাসচার’ চলতি বাংলায় ‘ঘাসের গালিচা’। রাস্তার অবস্থা ভালোই, তবে যেহেতু এদিক দিয়ে এখন কারগিল হয়ে লাদাখ যাবার ভিড়, ফলে তিন ঘন্টার ওপর লাগল ওখানে পৌঁছোতে। পাশ দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে সিন্ধু নদী বয়ে চলেছে, একেবারে চোখ জুড়োনো দৃশ্য যাকে বলে। কুল্লান-এ গাড়ি থামিয়ে সবাই নাস্তা সারছে আর নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, পাথরে বসে পটাপট ছবি তুলে নিচ্ছে। নদীটা সোনমার্গ অবধি যাবে না। তার আগেই অন্যদিকে ঘুরে চলে যাবে। আমরা কর্তা গিন্নি দুজনে দুটো ভুট্টা পোড়া খেয়ে আপাতত চালিয়ে দিলাম।
উঁচু পাহাড়ে ঘেরা অপুর্ব জায়গা সোনমার্গ। গাড়ি রেখে সবাই ঘোড়ার পিঠে চেপে পাহাড়ের একদম মাথায় ওঠে, বরফের শোভা দেখার জন্য। তারপর ক্লান্ত শরীরে ফিরতে ফিরতে দিন কাবার হয়ে যায়। আমরা ওই ঝামেলায় না গিয়ে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে হেঁটে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ালাম, কনিফার গাছে ঠাসা জঙ্গলের মধ্যে। চারপাশে কাছে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মহার্ঘ সব হোটেল আর রিসর্ট, তৈরি হচ্ছে আরও বেশ কিছু। এর ফলে জায়গায় জায়গায় স্তুপীকৃত হয়ে থাকা বালি আর বাড়ি বানানোর মাল মশলা এত সুন্দর পরিবেশে সামান্য রসভঙ্গ করছে বৈকি। একটা হোটেলের সামনে ছাতার তলায় দেখলাম সব চেয়ার-টেবিল সাজানো, কেউ বিশেষ নেই। নামটা দেখলাম ‘হোটেল ভিলেজ ওয়াক’। ওয়াকিং করে আমরাও তো কিঞ্চিৎ ক্লান্ত। ফলে বসে পড়তে অসুবিধে কোথায়? তাছাড়া গুছিয়ে একটা ছবিও আঁকতে হবে এই ফাঁকে। কাজ শুরু করতে না করতেই চারপাশে কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল।
এরা সবাই এখানকার কর্মচারী, চোস্ত সাজগোজ, শান্ত, ভদ্র, না চাইতেই আমাদের খাবার জল এনে দিল, ওয়াশ-রুম ব্যবহার করতে দিল। হোটেলের রিসেপশনে তখন চারজন বিশালবপু মহিলা ঘর খুঁজতে এসে নিজেদের মধ্যে তুমুল হইহল্লা লাগিয়েছে। কিছুক্ষণ শুনেও ধরতে পারলাম না ওদের ভাষাটা, বাংলা, ফরাসি না দক্ষিণ ভারতীয়? ঠিক ছিল ফেরার পথে মানসবল লেকটা ঘুরে নেবো, ড্রাইভার শমিম আসার সময়েই চেয়েছিল ক্ষীরভবানীর মন্দিরটাও দেখিয়ে দেবে। আমরা বলেছিলাম ‘পহেলে চলো সোনমার্গ।’ ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে না উঠতেই আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। দেখলাম সবাই তখন খোলা জায়গার মধ্যে একটু ছাঊনি খুঁজতে ব্যস্ত, একদল ঘোড়ার পিঠে চেপে নামছে ভিজে চুপচুপে হয়ে। আমরা আগেভাগে এসে খুব জোর বেড়িয়ে নিয়েছি এই যা রক্ষে। গাড়িতে শমিম জানাল, ও খবর পেয়েছে ক্ষীরভবানির রাস্তায় খুব জ্যাম, তাই যাওয়া যাবে না। মনে মনে ভাবলাম, ঝামেলা কমানোর জন্য বানিয়ে বলছে? নাকি মন্দির বলে এদের উৎসাহ কম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম সত্যি সেদিন ওখানে কী একটা মেলা বসেছিল।
মানসবল পৌঁছে অবশ্য প্রথমেই একটা মন্দির দর্শন হয়ে গেল আমাদের। পাথরের তৈরি ছোট তেকোনা শিবমন্দির, যার অনেকটা ডুবে রয়েছে একটা পুকুরের তলায়। পুকুরটার চারদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা। একটা বেজায় ঢ্যাঙ্গা লোক লম্বা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মন্দিরের মুখটাকে সামনে রেখে আমরা যেতেই লাঠির ডগাটাকে জলের তলায় ঢুকিয়ে দেখালো শিবলিঙ্গটা ঠিক কোথায় রয়েছে, আমরাও সেইমতো আন্দাজ করে নিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম জানালাম। তবে বোঝা গেল না লোকটাকে এই কাজের জন্য রাখা হয়েছে, না নিজের খুশিতে জনগনের সেবা করে চলেছে!
ইতিমধ্যে বাস বোঝাই স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওখানে এসে হাজির, সবাই আউটিং এর মেজাজে, মন্দির নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। কিছুক্ষণ দৌড়োদৌড়ি করে নিয়ে ওরা লেকের দিকে চলল আমরাও ওদের সঙ্গে পা বাড়ালাম। মানসবল লেকটা বিশাল বড়, এদিক ওদিক দেখা যায় না, পাড়ের একধারে সাফারি পার্কের মতো ছাউনিওলা বসার জায়গা, এছাড়া নাগরদোলা, রেস্টুরেন্ট, বোটিং-এর ব্যবস্থা— কিছু বাকি নেই। ছুটির মরশুম লোকের ভিড়ও তেমনি। পিছন দিকের পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে গাছপালা ঘেরা বেড়ানোর জায়গা। আমরা ওখানে গিয়ে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসলাম। ওপর থেকে লেক সমেত চারদিকটা আরও দূর অবধি দেখা গেল। লেকের চারদিক ঘিরে রয়েছে পাহাড়ের কোলে বেশ কিছু গ্রাম, জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রংবাহারি নৌকো, তাকিয়ে থাকতে থাকতে দিব্যি সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এর মধ্যে বাধ সাধল হালকা বৃষ্টি, এবার তাহলে ফিরতে হয়। পার্কের বাইরের রাস্তার ধারে সার দেওয়া দোকানে দেখলাম ভাজা হচ্ছে প্রায় গাড়ির চাকার সাইজের বড় বড় পরোটা, আর হলুদ রঙের ছোট ছোট মাছ। খরিদ্দারের ভিড় নেই তেমন। চারদিকে ধুলোও উড়ছে বিস্তর। আমাদের ড্রাইভার শমিমের মনে হল মাছের দিকে লোভ। ফলে ভদ্রতার খাতিরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিনতে হল কিলো দরে। আমি আর গিন্নি ঝুঁকি নিয়ে খেয়েও ফেললাম একটা করে বাকিটা চাপিয়ে দিলাম শমিমের ঘাড়ে। ওর লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখে বলতে হল ‘সকালের সেই ভুট্টা পোড়াগুলো আমাদের এখনও হজম হয়নি যে’।
অঙ্কনঃ দেবাশীষ দেব